অম্বুবাচি কি? জেনে নিন ইতিবৃত্ত

নিউজ দুনিয়া ২৪, ওয়েব ডেস্ক:সংস্কৃত “অম্ব ” মানে জল , আর “বাচি” মানে আরম্ভ
বা বৃদ্ধি ৷ প্রচন্ড গরমের পর আষাঢ়ের এই সময় পৃথিবী হয় সিক্ত ও বীজ ধারনের উপযোগী ৷ রাশি চক্রের ২৭টি নক্ষত্রের মধ্যে সূর্য যখন আদ্রা ( মানে ভেজা ভাব) নক্ষত্রে প্রবেশ করে সেই তিন দিন কুড়ি দন্ড সময়টাই “অম্বুবাচি ” ৷ বর্ষার জলে ভেজা এই সময় মনে করা হয় মা বসুমতী ( পৃথিবী মাতা) ঋতুমতী হয়েছেন ৷ রজঃস্বলা নারী যেমন এই সময় অনেক কাজ করেন না এই দিনগুলিতে চাষিরা কৃষিকাজ বন্ধ রাখেন ৷ ভারতের নানা স্থানে রজোৎসব হয় ৷ সন্ন্যাসী , যোগী , বিধবা মহিলারা এই তিন দিন রান্না করা ও আমিষ খাবার খান না ৷
“ত্বমেব প্রকৃতিদেবী ত্বমেব পৃথিবী জলম্ ৷
ত্বমেব জগতাং মাতা ত্বমেব চ জগন্ময়ী ৷’’
হিন্দু ধর্মে পৃথিবী হলেন ধরিত্রী মাতা। আর জাগতিক নিয়ম অনুযায়ী আদ্রা নক্ষত্র মিথুন রাশির অবস্থানকে বর্ষাকাল বলা হয়। আদ্রা নক্ষত্রে প্রথম পাদ ৩ ডিগ্রী ২০ মিনিট পর্যন্ত কালকে অম্বুবাচি বলা হয়। এই আদ্রা নক্ষত্র রবিতে প্রবেশ করলে অম্বুবাচি হয়। পৃথিবী রজ:স্বলা হয়। অর্থাৎ প্রকৃতি সিক্ত হয়। প্রাচীন হিন্দু ধর্মে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে যে, নারী ও ধরিত্রী এই দুইয়ের উর্বরতা এবং অনুর্বরতার স্বাভাবিক চক্রটি নিয়ে লজ্জার কোন কারণ নেই, বরং এটাই হল উৎসবের অঙ্গ। “কামাখ্যে কামসম্পন্নে কামেশ্বরী হরপ্রিয়ে ৷ কামনাং দেহি মে নিত্যং কামেশ্বরী নমোহস্তুতে “!
পৌরাণিক কাহিনী সকলের জানা, সতী বা পার্বতীকে দেহত্যাগ করার পর শিব তাকে নিয়ে প্রলয় নৃত্য শুরু করেছিল তাতে পৃথিবী অশান্ত হয়ে পড়েছিল। তখন শিবকে শান্ত করার জন্য বিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ ৫১ টি টুকরা করে। এবং সেইগুলি বিভিন্ন জায়গায় পড়েছিল। এই ৫১ টি জায়গা হল সতীপীঠ ৷ এরমধ্যে ৪টি পীঠ বেশী গুরুত্ব পায় ৷ তার একটি বিষ্ণুর চক্রে সতীর যোনী ছিন্ন হয়ে পরা কামাখ্যা । অস্ট্রিক ভাষায় “কা” মানে স্ত্রী ৷ “মেইখা” মানে জন্মদাত্রী ৷ এই তিন দিন কামরূপ কামাখ্যা মন্দির বন্ধ থাকে ৷
দেশ বিদেশ থেকে বহু ভক্ত এই বার্ষিক অম্বুবাচি মেলায় কামাক্ষায় এসে উপস্থিত হন। কামাক্ষার বিভিন্ন উৎসবের মধ্যে অম্বুবাচি হল বৃহতম উৎসব। বিবাহিত নারীরা যেমন সন্তানের জন্য দেবী কামাক্ষার আরাধনা করেন, সেই রকমই কৃষকরা ভূমি মাতার গর্ভে ফসলের আশায় কামাখ্যা দেবীর আরাধনা করেন।বড়দেউড়ী সমাজ পূজানুষ্ঠানে ব্যস্ত থাকেন !” কামরূপং মহাপীঠং সর্বকাম ফলপ্রদম্ “৷ ” কামাখ্যাবস্ত্রমাদায় জপপূজাং সমাচরে ৷ পূর্ণকামং লভেদ্দেবী সত্যং সত্যং ন সংশয় “৷ মা এখানে জীবনের প্রতীক ৷
কামাখ্যা মন্দিরের আসল নাম কামরুপ কামাখ্যা। এই মন্দিরটি আসামের নীলাচল পাহাড়ে অবস্থিত। এখানে মোট ১০টি রূপ বা দশ মহাবিদ্যার মন্দির রয়েছে। এই মন্দিরের দেবতার রুপ গুলো হল – কালী, তারা,ষোড়শী, ভূবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলামুখী, মাতঙ্গী ও কমলা। মধ্যযুগে হুসেন শাহের অনুপ্রবেশের সময় ১৪৯৮ সালে এই মন্দির ধংস করা হয়েছিল বলে কথিত আছে। ১৫৬৫ সালে পুরনায় মন্দিরটি নির্মান করা হয় কোচ সাম্রাজ্যের রাজা নর নারায়নের সময়ে ১৫৬৫ সালে ৷
আষাঢ় মাসে সারা পৃথিবী কামাখ্যার উৎসবের দিকে তাকিয়ে থাকে তা হল অম্বুবাচি। পৃথিবী ঋতুমতী হলেই অম্বুবাচি শুরু হয়। আর এই সময় বারি বর্ষনের সূচনা হয়। ভূমি তখন বীজধারন যোগ্যা হয়ে উঠে। অম্বুবাচি লাগলে তিনদিন মন্দিরের দ্বার বন্ধ থাকে। বন্ধ থাকে মন্দিরের পূজাপাঠ ও মন্দির দর্শন। চতুর্থ দিনে মন্দির খোলা হয়। প্রথমে দেবী স্নান তারপরেই পূজার সূচনা। পূজার পর পুন্যার্থ্যীরা গর্ভগৃহে প্রবেশের অনুমতি পান। অম্ববাচি যোগ শুরুর আগে কামাখ্যা মন্দিরে পুরোহিত মহামুদ্রা যোনিপীঠে বস্ত্র রাখেন। তিনদিন পর মন্দির খুলে দেখা যায় সেই সব বস্ত্র রক্তবর্ন ধারন করেছে। মায়ের কি অপার মহিমা! এবং ঐশ্বরিক প্রকাশ! এই কাপড়ের টুকরো কাছে রাখলে সব বাধা দূর হয় ৷
আম্বুবাচি কালে কী কী কর্তব্য ?
বামকেশ্বর তন্ত্রের ৫৫ তম পটলে । যথা :-
‘’আষাঢ়ে প্রথমে দেবী অম্বুবাচী দিনত্রয়ং ।
সংগোপন গৃহে দেবিং স্থাপয়েদ্বস্ত্র বেষ্টনে ।।
রাত্রৌ মহানিশা যোগে পঞ্চাচারেণ দেশিকঃ।
পূজয়িত্বা বলিং দত্বা হোময়িত্বা বিহারয়েৎ।।‘’
অর্থাৎ,- আষাঢ়ের প্রথমে অম্বুবাচী দিবসত্রয়ে দেবীকে গুপ্তভাবে বস্ত্রাদি দ্বারা বেষ্টন করিয়া ( বেষ্টন অর্থে চোখমুখ ঢেকে কাপড় চাপা দিয়ে রাখতে বলা হয় নি ) রাখিবে । অম্বুবাচী নিবৃত্তি হইলে সাধক মহানিশাতে পঞ্চতত্ত্ব দ্বারা দেবীর পূজা করিয়া, বলিদানাদি, হোমাদি সম্পন্ন করিবে । বলিদান বলতে নিরীহ অবলা পশুদের হত্যা নয়, আমাদের ষড়রিপু (কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য) এগুলিকে দেবীর চরণে উৎসর্গ করতে হবে।
সাধারণ মানুষের কর্তব্য কী ?
এই পাঁচদিন কোনোভাবেই শ্রীশ্রীরাধামদনমোহনের সেবাকাজ বন্ধ থাকবে না। অনেকেই ভুলবশতঃ প্রভুর বা শ্রীবিগ্রহের সেবাকাজ বন্ধ করে দেন, এটা অনুচিত। বিগ্রহ বা চিত্রপটেও কোনোরূপ আচ্ছাদন দেবেন না। তবে শাক্ত মতানুযায়ী দেবীর পূজার্চনা নিম্নলিখিত ভাবে করতে পারেন।
এই দিনগুলিতে আমাদের কর্ত্তব্য দেবীকে বিশেষভাবে যত্নে রাখা । এমন ধারণা ঠিক নয় যে দেবী এইসময় অশুচি বা অস্পৃশ্যা হয়ে যান । অনেকে এই সময় মায়ের নিত্যসেবাও বন্ধ করে দেন, যা একেবারেই অনুচিত । এই দিনগুলিতে আমাদের কর্ত্তব্য দেবীকে বিশেষভাবে যত্নে রাখা। উপরন্তু যথাসম্ভব একান্ত পরিবেশে নির্জন বাসের ব্যবস্থা করা উচিত । কোনভাবেই আমাদের কোন আচরণে মায়ের বিরক্তির উদ্রেক যেন না হয় সেদিকে সর্বদাই খেয়াল রাখতে হবে । সংকল্প বিহীন নিত্য পূজাপাঠ ও আচার অনুষ্ঠান যথাসম্ভব অনাড়ম্বর ভাবে পালন করা উচিত । কিন্তু এই সময় বেশী করে জপ-ধ্যান ইত্যাদি করা উচিত, এই কালে জপ করলে বহুগুণ ফল লাভ হয় । ভূমি কর্ষণ বা ভূমিতে কোনরকম আঘাত করা এবং ক্ষৌরকর্ম ইত্যাদি এই তিন দিন নিষিদ্ধ । সকল সাধক ও ভক্তগণেরই এই সময় সংযত জীবনযাপন করা একান্ত কর্ত্তব্য।
‘’জয় কামেশী চামুন্ডে জয় ভূতোপহারিণীI
জয় সর্বগতে দেবী কামেশ্বরী নমোহস্তুতেII’’
প্রবৃত্তি:- বুধবার রাত্রি ৮/১৯ মিনিট গতে
নিবৃত্তি:- আগামী রবিবার রাত্রি ৮/৪৩মিঃ এর পর